সিসিএন রিপোর্ট :
উম্মে হাবিবা, চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। এই বয়সেই সে এখন কৃষি কাজের সব কিছু শিখে গেছে। মা বাবাকে কৃষি কাজে সাহায্য করে। এতে করে তাদের নিজের ক্ষেত থেকে উৎপাদিত শাক সবজিতে নিজেরা পুষ্টি পাচ্ছে এবং বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে তাদের পরিবার।
উম্মে হাবিবা এমন শিক্ষা পেয়েছে তার স্কুল জালিয়া পালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। আর স্কুলে শিক্ষার্থীদের বাগান করে কৃষি কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ডব্লিউএফপি। এই কর্মসূচি ছাড়াও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য শিক্ষা, পাঠাগার বিষয়ে শিক্ষা ও পুষ্টি বিস্কুট বিতরণ করা হয়। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের কারণে ক্ষুদে ডাক্তার, ক্ষুদে কৃষক, লাইব্রেরিয়ান তৈরি হচ্ছে আর পুষ্টি পূরণ হচ্ছে বিস্কুট এবং শাকসবজিতে। শিক্ষার্থীরা থাকে সুস্থ । এভাবেই কক্সবাজার জেলার ২১১টি স্কুলের ৬০ হাজার শিশুর স্বাস্থ্য ভালো রাখছে এবং সুস্থ রাখছে ডব্লিউএফপি।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ডব্লিউএফপি’র সহযোগিতায় এবং ইউএসএইড এর অর্থায়নে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, উখিয়া এবং কুতুবদিয়ার সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ ২১১টি স্কুলে ৬০ হাজারের বেশি শিশুকে ২০১০ সাল থেকে স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামের আওতায় তিনটি বিষয়ে সহায়তা করে আসছে। এগুলো হচ্ছে ফুড ডিস্ট্রিবিউশন,লিটারেসি ইমপ্রুভ এবং হেলথ ও নিউট্রিশন। এতে কক্সবাজারে ২১১টি স্কুলের ৬০ হাজার শিশুর পুষ্টিপূরণ হচ্ছে। সরেজমিনে পরিদর্শনে এসে এসব তথ্য জানা যায়।

স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের সফলতার ব্যাপারে উখিয়া জালিয়াপালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এম. এ. তাহের বলেন, ডব্লিউএফপি’র সহযোগিতায় স্থানীয়ভাবে এই কর্মসূচি চালু রাখা সত্যি প্রশংসনীয়। পৃথিবীর কোনো দেশে দুপুরে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাওয়ার নজির নেই। শিশুরা প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাঁচ ঘণ্টা ও তৃতীয় হতে পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রায় দশ ঘণ্টা না খেয়ে স্কুলে অবস্থান করে।
ফলে প্রতি বছর শুধু ক্ষুধা আর অপুষ্টির তাড়নায় অসংখ্য শিশু স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়।কিন্তু ডব্লিউএফপি’র সহযোগিতায় ফুড ডিস্ট্রিবিউশন,লিটারেসি ইমপ্রুভ এবং হেলথ ও নিউট্রিশন প্রোগ্রাম সফলভাবে বাস্তবায়ন হওয়ায় শিশুরা স্কুলমুখী হওয়ার পাশাপাশি পুষ্টির অভাবজনিত কোনো রোগে ভুগছে না।
উখিয়া কামারিয়ারবিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রাশেদা বেগম সহ অভিভাবকরা দাবি করেন, ডব্লিউএফপি’র কার্যক্রমটি চালু হওয়ার পর থেকে এসব স্কুলে উপস্থিতির হার এখন প্রায় শতভাগ। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পরিবারে তিনবেলা খাবারের সামর্থা না থাকায় অনেক শিশুই অভুক্ত থেকে স্কুলে আসত। আবার অনেকে স্কুল কামাই দিত।
কার্যক্রমটি চালুর কারণে কোনো শিশুই অভুক্ত থাকছে না। সব শিশুই এখন নিয়মিত স্কুলে আসছে। ঝরে পড়ার রোধ হয়েছে।জেলার সর্বত্র ডব্লিউএফপি’রফুড ডিস্ট্রিবিউশন,লিটারেসি ইমপ্রুভ এবং হেলথ ও নিউট্রিশন কার্যক্রমটি শতভাগ বাস্তবায়িত করা সম্ভব হলে জেলার নিরক্ষরতা শূন্যবাগে নেমে আসবে আশা করা যায়।
এ ব্যাপারে স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম, ডব্লিউএফপি, কক্সবাজার জেলার প্রোগ্রাম এসোসিয়েট মোহাম্মদ আজাহারুল ইসলাম বলেন,ইউএসএইড এর অর্থায়নে এবং ডব্লিউএফপি’র সহযোগিতায় কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, উখিয়া এবং কুতুবদিয়াতে সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ ২১১টি স্কুলে ৬০ হাজারের বেশি শিশুকে ২০১০ সাল থেকে স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামের আওতায় তিনটি বিষয়ে সহায়তা করে আসছে। এগুলো হচ্ছে ফুড ডিস্ট্রিবিউশন,লিটারেসি ইমপ্রুভ এবং হেলথ ও নিউট্রিশন।আর এগুলো বাস্তবায়নে সহযোগী সংস্থা সহযোগিতা করছে।
এ প্রকল্পের আওতায় আমরা প্রত্যেক স্কুলে ৭৫ গ্রামের এক প্যাকেট ফোর্টিফাইড বিস্কুট দেয়া হয়। এছাড়া টিচারদের ক্লাস ইম্প্লেমেন্ট করার জন্য সাপ্লিমেন্টারি মেটেরিয়াল দেয়া হয়।এক্ষেত্রে আমরা গ্রেড-১ এবং গ্রেড-২ শিশুদের বাংলা বিষয়ে পড়ার দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করি। এছাড়া সকল শ্রেণীতে একটা করে পাঠাগার দেওয়া আছে যেটা প্রাইমারি থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণীর বাচ্চাদের পড়ার জন্য আগ্রহ করে। এছাড়া টিচারদের ক্লাস ইম্প্লেমেন্ট করার জন্য তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করি এবং লার্নিং মেটেরিয়াল দেয়া হয়। বাচ্চাদের আর খাতা,কলম,ওয়ার্ক বুক,স্টেরী বুক,পেনসিল,রাবার দেওয়া হয়।
এছাড়া প্রত্যেক স্কুলে আমাদের একটা লিটন ডক্টর গ্রুপ আছে যারা শিশুদের মাঝে স্বাস্থ্য বার্তা প্রেরণ করে। বিভিন্ন দিবস উদ্যাপনের শিক্ষকদের এবং শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করে। তারা শিক্ষার্থীদের বছরে দুইবার কৃমিনাশক ওষুধ সেবন করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ওজন উচ্চতা এবং তাদের দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করে। সেটা রেকর্ড করে শিক্ষকদের সাথে শেয়ার করে। যদি কোন সমস্যা থাকে তারা যেন পরবর্তীতে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করতে পারে। এছাড়া হেলথ ইমপ্রুভমেন্টের জন্য প্রত্যেকটা স্কুলে একটা করে সবজি বাগান তৈরি করি যেখানে এফও’র টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছে।
এছাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অফিস আছে সেই অফিসারও সহযোগিতা করে। এছাড়া প্রত্যেকটা স্কুলে আমরা এফও’র সহযেগীতায় একটা বাগান তৈরি করি যেখানে ১৫ সদস্যের ক্ষুদে কৃষিবিদ রয়েছে। যারা সবজিগুলোতে কি কি ভিটামিন আছে, কোন সময় কোন সবজি উৎপাদন করা হয় সে বিষয়গুলো সম্পর্কে তারা টেকনিক্যাল জ্ঞান অর্জন পারে এবং এটা পরবর্তীতে সকল শিক্ষার্থীদের মাঝে তারা এই বিষয়টা ছড়িয়ে দেয় । পরে তারা বাড়িতে গিয়ে তাদের বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার কর এবং বাবা-মায়েরা যাদের বাড়িতে এই ধরনের তাদের অল্প জায়গার মধ্যে উৎপাদন করতে পারে। এছাড়া কিভাবে একটা সুষম খাবারের প্লেট তৈরি করতে হয় সে বিষয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবকদের এ বিষয়ে সহযোগিতা করে।
ব্যতিক্রমধর্মী এ কর্মসূচি পরিদর্শনে এসে ডব্লিউএফপি(ইতালি) পার্টনারশিপ অফিসার নাথানিয়েল গ্লিডেন বলেন, বাংলাদেশে আজকে এই অনুষ্ঠানটি দেখলে স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামের গুরুত্বের একটি শক্তিশালী পন্থা। ক্ষুধার্ত শিশুরা শেখে না। স্বাস্থ্যকর এবং সুপুষ্ট শিশুরা আরও ভাল শিখে।এটি স্কুলের খাবারে বিনিয়োগের গুরুত্বের একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা, যাতে বাচ্চারা স্কুলে থাকে। এটি একটি উপায় যে শিশুরা তাদের জীবনে তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে এবং পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।এটি একটি শক্তিশালী বিনিয়োগ যা যেকোনো দেশ তাদের নিজেদের ভবিষ্যতে করতে পারে।
ডব্লিউএফপি-এর স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামে সহায়তা দিয়েছে ইউনাইটেড স্টেটস্ অব আমেরিকা ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার (ইউএসডিএ)-এর ম্যাকগভার্ন-ডোল ইন্টারন্যাশনাল ফুড ফর এডুকেশন এন্ড চাইল্ড নিউট্রিশন প্রোগ্রাম।