শনিবার, জানুয়ারি ১৮, ২০২৫

গুপ্তখালে নয় ‘রিপ কারেন্টে’ মৃত্যু হচ্ছে পর্যটকদের, দাবী সমুদ্র বিজ্ঞানীদের

সাইদুল ফরহাদ:

কক্সবাজার সমুদ্রে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। চলতি সপ্তাহে সমুদ্রে গোসল করতে নেমে ডুবে এবং ভেসে গিয়ে শিক্ষার্থীসহ সলিল সমাধি ঘটেছে ২ জনের। এই নিয়ে চলছে নানান আলোচনা সমালোচনা। তবে অনেকেই ধারণা করছেন এই মৃত্যু গুলো গুপ্তখাল বা অচেতনতার কারনে হচ্ছে। তবে সমুদ্রে বিজ্ঞানীরা বলছেন গুপ্তখাল নয় রিপ কারেন্ট বা সমুদ্রের উল্টো স্রোতের কারনে এসব মৃত্যু হচ্ছে। মৃত্যুর মিছিলের জন্য অনেকেই বলছেন গুপ্তখাল। রিপ কারেন্ট হচ্ছে একধরনের ঢেউ যা সমুদ্রতটে ধাক্কা খেয়ে উল্টো দিকে অর্থাৎ গভীর সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়। সমুদ্র থেকে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙেলে দুদিক থেকে আসা এ ঢেউ প্রথমে সমুদ্র সৈকতে ধাক্কা দেয়, তারপর সরু একটি পথ ধরে আবার সমুদ্রে ফিরে যায়। যদি কেউ এ স্রোতে পড়েন তাহলে তার জীবিত ফিরে আসা দুষ্কর।

সী সেফ লাইফ গার্ডের তথ্য মতে গত ৫ বছরে কক্সবাজার সমুদ্র ডুবে প্রাণহানি হয়েছে ১৮ জনের। ২০১৯ সালে ৩ জন, ২০২০ সালর ২ জন, ২০২১ সালে ৩ জন, ২০২২ সালে ৬ জন, চলতি বছরেই মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। গত ১০ বছরে তারা ৫২৮ জনকে পর্যটককে ডুবে যাওয়ার সময় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে, এর মধ্যে ৯০% পর্যটককে উদ্ধারে ভাসমান সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয় ৷

এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্স ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দারের সাথে।

তিনি জানান, রিপ কারেন্টকে অনেক সময় উল্টো স্রোতও বলা হয়।অনেক সময় সমুদ্রের ঢেউ সৈকতের বালিয়ারিতে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারনে একটি চিকন পথ ধরে সমুদ্রে ফিরে যেতে পারে এবং এই সরু পথে যে কেউ অবস্থান করলে এই উল্টো স্রোত তাকে টেনে সাগরে নিয়ে যেতে পারে।

রীপ কারেন্ট এতটাই শক্তিশালী হতে পারে যে একজন অভিজ্ঞ সাতারুকেও সাগরে টেনে নিয়ে যেতে পারে।উপকূলে যেকোন সময় যে কোন স্থানে রিপ স্রোত সৃষ্টি হতে পারে,অনেক সময় খালি চোখে তা অনুভব করা যায়না। তাই সাগরে গোসল করতে নামার সময় সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।

রিপ স্রোত মানুষকে পানির নিচে টানে না; বরং উপকূল থেকে মানুষকে দূরে টেনে নিয়ে যায়।রিপ কারেন্ট সাধারণত নীচের দিকে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়, যার ফলে একজন পর্যটকের পা নিচ থেকে ছিটকে যেতে পারে,যাতে তার মনে হয় যেন পানির নিচে কিছু একটা তাকে টানছে।

এটি মূলত মানুষকে ডুবিয়ে দেয় না।এটি কখনো কখনো এতটাই শক্তিশালী হয় যে যখন রিপ স্রোত মানুষকে টেনে নিয়ে যায় তখন মানুষ সাঁতার কাটতে ও নিজকে ভাসিয়ে রাখতে অক্ষম হয়। ভয়, আতঙ্ক, ক্লান্তি বা সাঁতারের দক্ষতার অভাবের কারণে মানুষের মৃত্যু হয়। তবে গুপ্ত খাল বলতে কিছু নেই।

মঙ্গলবার (২৫এপ্রিল) কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ভেসে গিয়ে যে দুই পর্যটকের মৃত্যু হয় সেটা নিয়ে কথা সি সেফ লাইফগার্ড লাইফ সেভিং ট্রেইনার জয়নাল আবেদীন ভুট্টোর সাথে। তিনি সিসিএন কে জানান,আমি পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করছি ১২ বছর। আমরা টেনিং নিয়েছি বিদেশি থেকে। আমরা সমুদ্র সৈকতের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কাজ করি ৩১ জন। সমুদ্র সৈকতে গোসল করতে নেমে পর্যটকদের মৃত্যুর কারন হলো রিপ কারেন্ট বা সমুদ্রের উল্টো স্রোত। রিপ কারেন্ট একধরনের ঢেউ যা সমুদ্রতটে ধাক্কা খেয়ে উল্টো দিকে অর্থাৎ গভীর সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়। আমরা অনেক সময় দেখে থাকি সমুদ্র যখন রিপ কারেন্ট সৃষ্টি হয় তখন প্রচুর স্রোত সৃষ্টি হয়। ঐ সময় পর্যটকরা যদি কোন ভাসমান জিনিস অর্থাৎ টিউব, প্লাস্টিক জাতীয় ভাসমান কিছু নিয়ে সাঁতার কাটে তাহলে রিপ কারেন্টের কবলে পড়ে। যার এ স্রোতে পড়েন তাহলে তার জীবিত ফিরে আসা দুষ্কর। এ কারণে এটাকে সাগরের ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদ বলেও অভিহিত করি আমরা।

মঙ্গলবার (২৫এপ্রিল) আমি দায়িত্ব ছিলাম লাবনী পয়েন্টে। আমি ওয়াচ টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম । তখন দেখছিলাম সমুদ্রের পানি গাঢ় নীল ও খুব শান্ত মনে হচ্ছিল। এটা মানে হচ্ছে রিপ কারেন্ট সৃষ্টি হচ্ছে। সবাইকে সতর্ক করার আগে এক সাথে ৩পর্যটক ভেসে যায়। তার মধ্যে একজনকে উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও দুইজনের মৃত্যু হয়। এজন্য আমাদের পর্যটকদের কিছু দোষও আছে। আমরা লাল পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করি । লাল পতাকা মানে বিপদ সংকেত । কিন্তু পর্যটকরা অমান্য করে সেখানে গোসল করতে নামেন। যার কারণে এই সব দুর্ঘটনা হয়ে থাকে ।

টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোল্লা মোহাম্মদ শাহিন বলেন, গুপ্তখাল এর বিষয়ে আমার তেমন জানা নেই।তবে সমুদ্র সৈকতে রিপ কারেন্ট সৃষ্টি হয়। এটির জন্য আমরা পর্যটকদের সচেতন করে থাকি। আমাদের আরো সর্তক হতে হবে।

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ফিল্ড টিম ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সমুদ্র সৈকতের ৮০ ভাগ মৃত্যুই হয় এ রিপ কারেন্টের জন্য। সমুদ্র সৈকতে যখন রিপ কারেন্ট সৃষ্টি হয় তখন স্রোতের টান বেশি থাকে। যেসব পর্যটক টিউব নিয়ে গোসল করতে নামেন বেশির ভাগ তারা বিপদের সম্মুখীন হন। এই বিপদজনক বিষয়ে পর্যটকদের সতর্ক করতে আমরা তেমন কিছু করতর পারেনি। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাব রয়েছে আমাদের।

আরও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ খবর

error: Content is protected !!