সিসিএন অনলাইন ডেস্কঃ
তাকে বলা চলে ফাইনাল ম্যাচের খেলোয়াড়। যে কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনালে তিনি মাঠে থাকলে জয়ের গ্যারান্টি দিয়ে দেয়াই যায়। এস্তাদিও দি বেনফিকা থেকে লুসাইল স্টেডিয়াম – আলো নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছেন অ্যানহেল ডি মারিয়া। আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানাতে চলেছেন আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি উইঙ্গার। ফাইনালে জ্বলে ওঠা যার অভ্যাস, সেই ডি মারিয়া আর্জেন্টিনার বিখ্যাত আকাশি-সাদা জার্সিকে বিদায় জানাচ্ছেন ফাইনালের মঞ্চেই।
লিওনেল মেসির সঙ্গে একই দলে খেলায় কখনোই পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে পারেননি ডি মারিয়া। ছবি: এপি
লিওনেল মেসির সঙ্গে একই দলে খেলায় কখনোই পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে পারেননি ডি মারিয়া। ছবি: এপি
খেলার সময়
আর মাত্র একটি ম্যাচ; তারপরই আলবিসেলেস্তের জার্সিতে অতীত হয়ে যাবেন অ্যানহেল ডি মারিয়া। লিওনেল মেসির মতোই রোসারিওর সন্তান তিনি। মেসির মতোই ক্লাব ও জাতীয় দলে সম্ভাব্য সকল শিরোপা জিতেছেন তিনি। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের প্রতিই শিরোপা উৎসবে তিনি ছিলেন মেসির পাশেই। প্রতিটি ফাইনালে তিনি জ্বলে উঠেছেন, তার রোশনাইয়ের সামনে ম্লান হয়েছে মাঠে থাকা বাকি ২১জন। তবু কেন জানি নায়ক হয়ে ওঠা হয়নি ডি মারিয়ার।
ক্লাব ফুটবল থেকে জাতীয় দল কোথাও নায়ক হয়ে ওঠা হয়নি রোসারিওর সেই দেবদূতের। ২০১৪ সালে অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে মাঠের সেরা খেলোয়াড় তিনিই। জিতেছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। কিন্তু ৯৩ মিনিটে সমতাসূচক গোল করে রিয়ালের লা দেসিমা জয়ের নায়ক বনে গেলেন সার্জিও রামোস। সেই সঙ্গে পুরো টুর্নামেন্টে গোলের বন্যা বইয়ে দেয়া ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ছায়ায় ঢাকা পড়ে রইলেন ডি মারিয়া।
আর্জেন্টিনার জার্সিতে ডি মারিয়া আর মেসি সঙ্গী সেই বয়সভিত্তিক ফুটবল থেকেই। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে এক সঙ্গে খেলেছেন দুজনই। সেই অলিম্পিকের কোয়ার্টার ফাইনালে মেসি-ডি মারিয়ার গোলেই নেদারল্যান্ডসকে হারায় আর্জেন্টিনা। এরপর ফাইনালে ডি মারিয়ার একমাত্র গোলেই নাইজেরিয়াকে হারিয়ে আর্জেন্টিনা তাদের সবশেষ অলিম্পিক ফুটবলের সোনা জেতে। তারপরও সেভাবে আলোচনায় জায়গা পাননি ডি মারিয়া।
জাতীয় দলে ডি মারিয়ার আগেই অভিষেক হয় মেসির। ২০০৬ সালে প্রথম বিশ্বকাপে সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রোর বিপক্ষে গোল করে রাতারাতি পরিচিতি পান মেসি। নতুন ম্যারাডোনা হিসেবে তখনই খ্যাতি লুটাচ্ছে তার পায়ে।
২০১০ এর বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মঞ্চে আবির্ভাব ডি মারিয়া। মেসি ততদিনে বিশ্বের সেরা ফুটবলার হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছেন। বার্সেলোনার হয়ে রেকর্ডের বন্যা বইয়ে দিয়ে ব্যালন ডি’অরও জিতেছেন প্রথমবারের মতো। এক সময়ের সতীর্থ ডি মারিয়া সেই তুলনায় তখনও প্রতিভাবান খেলোয়াড় হিসেবেই পরিচিত, খেলেন বেনফিকায়।
লিওনেল মেসির মতো ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়ের পাশে খেললে ধ্রুবতারার আলোও চোখ কাড়তে পারে না। ফুটবল জাদুকরের পাশে ডি মারিয়াকেও তেমনই মনে হয়। আলবিসেলেস্তে জার্সিতে পার্শ্বতারকার ভূমিকাটা অবশ্য অপছন্দও করেন না এল ফিডেও। ডি মারিয়ার অভাবটা বোঝা যায় যখন তিনি দলে থাকেন না।
২০১৪ বিশ্বকাপের কথাই ধরা যাক। মেসি ম্যাজিকে সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে জায়গা করে নেয় আর্জেন্টিনা। ২৪ বছর পর বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা। অমরত্ব সে বিশ্বকাপেই পেয়ে যেতেন মেসি, যদি ফাইনালটা জিততে পারতেন। বিস্তর আলোচনা তখন। কিন্তু পুরো আর্জেন্টিনা দল দুশ্চিন্তায় ডি মারিয়ার ইনজুরি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনাকে অতিরিক্ত সময়ের গোলে হারিয়ে চতুর্থবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। তবে সবারই এক কথা, ফাইনালে ডি মারিয়া থাকলে ম্যাচটার ফল হয়তো অন্যরকম হতো।
ডি মারিয়া থাকলে ফল কী হতে পারতো, তা বোঝা গেছে আট বছর পরের ফাইনালে। কাতার বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটায় ফ্রান্সকে কাঁপিয়ে দেন ডি মারিয়া। ফরাসিরা কড়া পাহারায় রেখেছিল মেসিকে। কিন্তু ফাইনালে সব আলো নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছিলেন ডি মারিয়া। ২৩ মিনিটে ফ্রান্সের ডি বক্সে ঢুকে পড়লেন বিপজ্জ্বনকভাবে। তাকে আটকাতে গিয়ে ওসমান দেম্বেলে ফাউল করে বসলেন। আর্জেন্টিনার পক্ষে পেনাল্টির বাঁশি বাজালেন রেফারি। স্পটকিক থেকে মেসির গোলে এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা। এরপর ৩৬ মিনিটে গোল করলেন ডি মারিয়া নিজেই। প্রথমার্ধেই ২ গোলের লিড নিয়ে ৩৬ বছরের খরা ঘুচানোর স্বপ্ন দেখতে থাকে আলবিসেলেস্তেরা।
দ্বিতীয়ার্ধে ফ্রান্স ম্যাচে ফেরে। কিন্তু সেটা ডি মারিয়া মাঠ ছাড়ার পর। ২ গোলের লিড পাওয়ার পর কোচ স্ক্যালোনি ডি মারিয়াকে তুলে নেন। এরপরই ফ্রান্স খেলায় ফিরতে থাকে। কিলিয়ান এমবাপ্পের হ্যাটট্রিকে ম্যাচটা টাইব্রেকারে যায়। সেখানে এমি মার্টিনেজের বীরত্বে জয় আর্জেন্টিনার।
৩৬ বছর পর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। অমরত্বের স্বাদ পান মেসি। সর্বকালের সেরার বিতর্কও নাকি শেষ সেদিনই। মঞ্চের সবটুকু আলো মেসির ওপরেই, পার্শ্বনায়ক ডি মারিয়া তার পাশে ছায়ামানব!
বিশ্বকাপের এক বছর আগেই ঘুচেছিল আর্জেন্টিনার শিরোপাখরা। ২৯ বছর পর কোপা আমেরিকায় চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই মেসি অতিমানবীয় ফুটবল খেলেন। কিন্তু ফাইনালের চিত্রনাট্যটা মনে হয় ডি মারিয়াকে কেন্দ্র করেই লেখা হয়েছিল। ব্রাজিলের বিপক্ষে ফাইনালে একমাত্র গোলটি ডি মারিয়াই করলেন। বন্ধু মেসিকে এটি তার দেয়া সেরা উপহার। কোপা আমেরিকা ও বিশ্বকাপের মাঝে লা ফিনালিসিমায়ও স্কোরকার্ডে নাম লিখিয়েছেন ডি মারিয়া। তার সময়ে আর্জেন্টিনার জেতা প্রতিটি ফাইনালেই অন্তত একটা হলেও গোল করেছেন এই উইঙ্গার।
কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে মেসির দুই গোলের মাঝে ডি মারিয়া একটি গোল করেন। বিশ্বকাপ জেতার মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য সকল শিরোপাই জেতা হয়ে গেছে তার। ছবি: সংগৃহীত
আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে শেষ ফাইনাল খেলতে নামছেন ডি মারিয়া। বন্ধু মেসি শিরোপা হাতেই বিদায় দিতে চান ডি মারিয়াকে। ফাইনালে এই উইঙ্গারের পা থেকেই একটা গোল চান। এতোদিন আর্জেন্টিনার জন্য নিজের সেরাটা উজাড় করে দিয়েছেন ডি মারিয়া। বন্ধু মেসিকে শিরোপা এনে দিতে পালন করেছেন পার্শ্বনায়কের ভূমিকা। বিদায়বেলায় এই ফাইনালে মেসি ও আর্জেন্টিনা নামছে ডি মারিয়াকে শিরোপা হাতে বিদায় দিতে।
পার্শ্বনায়ক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে থাকছেন নায়কের চরিত্রে। আর্জেন্টিনার ফুটবলের আনসাং হিরো, বিশ্বফুটবলের অন্যতম আন্ডাররেটেড ফুটবলার ডি মারিয়ার ফুটবলের কাছে এতোটুকু প্রাপ্যই বটে।