সাইদুল ফরহাদ :
কক্সবাজার টেকনাফ নাফ নদীতে মাছ ধরতে গেলে রোহিঙ্গা সন্ত্রসীদের চাঁদা দিতে হয় বাংলাদেশি দরিদ্র জেলেদের। রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের পর এবার নাফনদীতে শুরু হয়েছে ব্যাপক চাঁদাবাজি।
মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন “নবী হোসন” বাহিনী এসব চাঁদাবাজি করছে। টেকনাফ জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে তারা। জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হচ্ছে। চাঁদাবাজির এ টাকা দিতে কেউ অপারগতা প্রকাশ করলে অপহরণ করে মায়ানমারে অভ্যন্তরে তুঁতারডিয়া নামক একটি দ্বীপে নিয়ে চালানো হয় বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন। এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটছে। বাংলাদেশ -মায়ানমার জিরো পয়েন্টের মাঝখানে তুঁতার দ্বীপ, অসসের ডিয়া ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫ শতাধিক সদস্যের বাহিনী গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন। টেকনাফে নতুন আতঙ্কের নাম নবী হোসেন। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে মাদক, অস্ত্র পাচার, অপহরণ ও ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িত এই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী।
নাফনদীতে মাছ শিকার করতে হলে এই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে দিতে হয় মাসিক চাঁদা।অন্যদিকে লেনদেনের পর বতেকা নামক দেয়া হয় একটি বিশেষ টোকেন। আর এ টোকেন নিয়ে নাফ নদীতে মাছ শিকার করতে পারতে। বাংলাদেশি জেলেরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

নাফনদীতে মাছ শিকার জন্য নবী হোসন বাহিনীর বতেকা নামক টোকেনটি প্রতিবেদেকের হাতে আসে। যে টোকেনটি দেখতে সাদা রঙের। এবং মায়ানমারের বর্ণমালায় হাতের লেখা।এই নবী হোসন বাহিনী কে চাঁদা না দেওয়ায় উপজেলা হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনছিপ্রাং এলাকার ৭ বাংলাদশীকে নাফনদী থেকে অপহরণ করছে। ৭ জনের মধ্যে ৫জন ফিরেছেন।
অপহৃতরা হলেন,হোয়াইক্যং উনছিপ্রাং এলাকার সাইফুল হকের ছেলে মোহাম্মদ মানিক (১৮) ও একই এলাকার বখতারের ছেলে সোহেল বদি (১৮),ছিদ্দিকের ছেলে মুজিদ(১৫), একই এলাকার বাসিন্দা ধুলু(৪৫)
২২নং ক্যাম্পের মোহাম্মদ শফিক (৩২)।
মঙ্গলবার (১১জুলাই) নবী হোসেন বাহিনীকে মুক্তিপন দিয়ে ফেরত আসা উনছিপ্রাং এলাকার সাইফুল হকের পুত্র মোহাম্মদ মানিক বলেন, আমাদের সংসার চলে নাফনদীতে মাছ শিকার করে। রোহিঙ্গা আসার পর থেকে নাফনদী এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাফনদীতে গেলে এখন সেটার জন্য দিতে হয় চাঁদা। চাঁদা না দিলে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে মুক্তিপন আদায় করা হয়। আমাকেও তারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল একমাত্র আমি তাদের কাছ থেকে বতাকা (টোকেন) নি নাই তাই। এই বতাকা (টোকেন) নিতে দিতে হয় ৫-১০ হাজার টাকা।আবার মাছ বেশি পেলেও সেখান থেকে তাদের বরাদ্দ দিতে হবে। এইভাবেই আমাদের শোষণ করে খাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। একটি স্বাধীন দেশে কীভাবে অন্য দেশের লোক আমাদের শাসন করছে।

অপহৃত আরেক যুবক মোহাম্মদ ধুলু বলেন, এমনিতেই নাফনদীতে মাছ শিকার নিষিদ্ধ ৭ বছর। কিন্তু রোহিঙ্গারা কোন বাঁধা ছাড়া মাছ শিকার করছেন। নাফনদীর পাশে আমাদের কিছু চিংড়ি ঘের আছে। এই চিংড়ি ঘের দিয়ে আমাদের সংসার চলে। কিন্তু আমরা এখন নাফনদীর পাশেও যেতে পারি না। নাফনদীর পাশে গেলেও সেখান থেকে ধরে নিয়ে যাই রোহিঙ্গারা। আবার আমরা নাফনদীর কিছু খালে জাল ফেললেও সেটার জন্য নবী হোসেন বাহিনী কে দিতে হয় চাঁদা। আমার সংসারে কয়েকদিন ধরে অভাব চলছিল। আমি তাদের কাছ থেকে যে বতাকা (টোকেন) নিয়েছিলাম সেটার মেয়াদ শেষ হাওয়ায় নতুন করে বতাকা(টোকেন) নিতে পারি নাই বলে তারা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে ৩দিন একটানা মারধর করে আমাকে ছেড়ে দেয়।
ধুলু কে তাদের আস্তানার সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মায়ানমার – বাংলাদেশ জিরো পয়েন্টের মাঝখানে ছোট ছোট কয়েকটি দ্বীপ আছে। যেগুলো হচ্ছে তুঁতার দ্বীপ, অসসের ডিয়ার এদিকে। যেটির দূরত্ব টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড উনছিপ্রাং বিজিবি পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ২০কি.মি দক্ষিণে। ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে যেতে সময় লাগে ২ঘন্টামত।
আমাকে তাদের যে আস্তানায় নিয়ে গিয়েছিল সেখানে তাদের কয়েকশত সদস্য আছে। যাদের হাতে ভারী অন্ত্র আছে। আমাদের এই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী থেকে রক্ষা করুন না হয় আমরা না খেয়ে মারা যাবো বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই যুবক।
এই নবী হোসেন বাহিনীর সদস্যরা আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে বাংলাদেশী ও ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালিয়ে আসছে। কয়েকমাস ধরে তারা টেকনাফে ব্যাপক হারে চাঁদাবাজি করছে। জীবনের নিরাপত্তার ভয়ে এ বিষয়ে কেউ কথাও বলছে না।
হোয়াইক্যং লম্বাবির এলাকার মৎস্য সমিতির নেতা মোহাম্মদ মাবু বলেন,তার কাছ থেকে গত এক মাসে কয়েক দফায় ৩০ হাজার টাকা চাঁদা নিয়েছেন নবী হোসেন বাহিনী নামক একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। জীবনের নিরাপত্তার কারণে এ চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জানানো হয়েছে।
কে এই নবী হোসেন?
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্টে বসবাসকারী মোস্তাক আহমেদের ছেলে নবী হোসেন (৪৭) মিয়ানমারের মংডু ডেভুনিয়া তুমরা চাকমাপাড়ায় আরএসও কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। সেখানে প্রতিপক্ষের দ্বন্দ্বে একটি হত্যা মামলার আসামি হয়ে ২০১২ সালে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমায়। সেখানে মাদ্রাসায় চাকরি নেয়।
২০১৭ সালের আগস্টে তার পরিবার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরপর নবী হোসেন কুতুপালংয়ে পরিবারের কাছে চলে আসে। সে সময় তাকে দলে নিতে চাপ দেয় আরসা। এতে রাজি না হলে ক্যাম্প ছাড়তে বাধ্য হয়। তখন মাদক চালানে জড়িয়ে পড়ে। এরপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাহিনী গড়ে। ২০১৮ সালে মাদকের বড় চালান নিয়ে আসে বাংলাদেশে। এরপর থেকে ইয়াবার সব বড় চালান তার হাত ধরে দেশে আসছে। এখনও আরএসও’র কিছু নেতার সঙ্গে নীবর যোগাযোগ রয়েছে। ওপারে তার প্রশিক্ষণ সেন্টার আছে।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, পুলিশের লিস্টে থাকা এই সন্ত্রাসীর স্বজনরা ওই ক্যাম্পের বি-৪১ ব্লকে তালিকাভুক্ত হলেও নবী হোসেন কোনও ক্যাম্পে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নবীর এক ভাই ভুলু মাঝি ক্যাম্প-৮ ইস্টে দায়িত্বে থাকাকালীন তাকে অপরাধ কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করার কারণে দায়িত্বে থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে তার আরেক ভাই মো. কামাল ক্যাম্প ৮ ইস্টের বি-৪১ ব্লকের মাঝির দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া ক্যাম্প-৮ ইস্ট, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বরসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে দুই শতাধিক সক্রিয় সদস্য রয়েছে নবীর।
রোহিঙ্গা নেতাদের ভাষ্য, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে নবী হোসেন গ্রুপের ২০০ সক্রিয় সদস্য আছে। এর মধ্যে নারী সদস্য আছে। তাদের মধ্যে কিছু সদস্যের বাংলাদেশ-মিয়ানমারে আসা-যাওয়া রয়েছে। তাদের মূল পেশা মাদক চালান এনে ক্যাম্পে মজুত ও বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া। এছাড়া সন্ত্রাসী ইসলাম ও মাস্টার মুন্না গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তার গ্রুপের।
সম্প্রতি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে নবী হোসেন এবং তার সহযোগীদের নাম উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে নবী হোসেনকে মাদক পাচারের মূলহোতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
নবী হোসেন এখন কোথায়?
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে নবী হোসেন বর্তমানে মিয়ানমারের নাফ নদীর তোতাল দ্বীপ ও কোয়ানচিমং (যা হোয়াইক্যংয়ের কাছে) নামক স্থানে বসবাস করছে। সেখানে একজন জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে তিনটি বড় বড় চিংড়ির ঘের লিজ নিয়ে মাছ চাষের নামে মাদক ও চোরাচালান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সেখানে গরু ও মহিষের খামার রয়েছে। তার গ্রুপের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে। দুই দেশে তার অনুসারী আছে। তার গ্রুপের সদস্যরা ক্যাম্পে মাঝেমধ্যে ত্রাণ দেয়। ত্রাণের ছবি ও ভিডিও তুলে সেগুলো ‘মানবিক নবী হোসেন’ দাবি করে রোহিঙ্গাদের পরিচালিত ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করা হয়। এমনকি ক্যাম্প থেকে স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে তার গ্রুপের সদস্যরা।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ আনোয়ারি বলেন, বেশ কয়েকমাস ধরে আমার এলাকার জেলেদের নবী হোসন বাহিনী নামক একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ জেলেদের ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে।মূলত এই সন্ত্রাসী গ্রুপ একটি মাসিক টোকেন চালু করেছে। যাদের কাছে এই টোকেন থাকবে তারা শুধু মাছ শিকার করতে পারবে। এটি যাদের কাছে থাকে না তাদের ধরে নিয়ে মুক্তিপণ ও নির্যাতন করা হয়। এবং কি হত্যাও করা হয়। এটি আমাদের টেকনাফের জন্য অশনিসংকেত।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা আগমনের পর থেকে টেকনাফ উপজেলায় কয়েক দিন পর পর স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকজন অপহরণ পরবর্তী মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে এটি পর্যটন নগরীর জন্য অশুভলক্ষণ এবং প্রতিনিয়ত উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠছে অপহরণের ঘটনা গুলো। এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনার চোখে না দেখে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত হবে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রয়োজনে যৌথ বাহিনী গঠন করে একটি সাড়াশি অভিযানের দাবী রাখা যায়।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি আব্দুল হালিম বলেন, কয়েকজন জেলে অপহরণ হয়েছিল যে শুনেছি এবং তারা ফেরতও আসছে। এই ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। নবী হোসেন বাহিনী বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সন্ত্রাসী গ্রুপ গুলো চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।