সাইদুল ফরহাদ :
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণায় রোহিঙ্গাদের ব্যবহারে শঙ্কিত সাধারণ ভোটাররা। বিশেষ করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসন নিয়ে এ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২০১৭ সালে এই আসনে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে প্রায় ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গা। এই কারণে উখিয়া -টেকনাফে রাজনীতি সমাবেশ ও মিছিল-মিটিং কিংবা স্বার্থান্বেষী মহল সহিংসতা ঘটাতে প্রলোভনে ফেলে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে পারে এমনটি মনে করা হচ্ছে।
গত ২০২৩ সালের ১২মার্চ কক্সবাজারের উখিয়ায় উপজেলা যুবলীগের সম্মেলনে অংশ নিতে এসে ট্রাকভর্তি ২৭ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। এর পর এটা নিয়ে পুরো দেশে সমালোচনা হয়। এবার আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করার শঙ্কা হচ্ছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রার্থীদের অভিযোগ, নির্বাচনের মিছিল-মিটিং কিংবা স্বার্থান্বেষী মহল সহিংসতা ঘটাতে প্রলোভনে ফেলে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে। তবে এরই মধ্যে সব প্রার্থীকে নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ। পাশাপাশি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন।
ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে কেউ পায়ে হেঁটে, কেউবা পণ্যবাহী পিকআপে চেপে যোগ দিচ্ছেন রাজনৈতিক নানা আয়োজনে। সঙ্গে দল ও বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়েও নানা স্লোগান দিতে দেখা যায় এসব শিশুদের।
১২মার্চ ২০২৩সালে কক্সবাজারের উখিয়ায় উপজেলা যুবলীগের সম্মেলনে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক হাওয়া কুতুপালং ক্যাম্পের যুবক মোহাম্মদ হাশিম বলেন, টাকা দেওয়ার কথা বলে আমাদের নেওয়া হয়। যাওয়ার পথে উখিয়া সদরের ফরেস্ট এলাকায় পুলিশ থামিয়ে আমাদের আটক করে।পুরে ক্যাম্পে ফেরত পাঠান। তবে আমাদের কাজ দিবে বলে ক্যাম্প থেকে বের করা হয়েছে।
উনছিপ্রাং ২২নং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা যুবক রফিক বলেন, জামাল এক স্থানীয় নেতা ২শত টাকা করে দিবে বলছে। আমাকে ৩০জন লোক আনতে বলে। তবে কোথায় যাবে সেটা বলেনি। আমাদের কে স্লোগান শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেটা করেছি।বিনিময়ে টাকা পেয়েছি।
অনেকেই আবার ভুয়া আইডি কার্ড ও জন্ম নিবন্ধন বানিয়ে নিজেদের ভোটার পরিচয় দিয়ে রাজনৈতিক সমাবেশে অংশ নেন।তারা দলীয় টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে নানা স্লোগানে রীতিমতো রাজনৈতিক আয়োজনে তারা!
২০২৩ (১৫ অক্টোবর)টেকনাফ উপজেলা ভ্যান চালক শ্রমিক সমিতি উদ্যোগে শোভাযাত্রা ও পিকনিকে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি। এসময় সংগঠনের ১২০ জন সদস্য শোভাযাত্রায় যোগদান করে। এ ১২০ জন সদস্যের মধ্যে ২০ জন তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা রয়েছে বলে জানান সংগঠনের এক নেতা। এটা নিয়ে পুরো আলোচনার ঝড় উঠে।
কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়ার কুতুপালং টিভি টাওয়ার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের পাশেই রয়েছে রোহিঙ্গাদের শত শত বসতি। আর রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে যেতে না পারে সে জন্য দেয়া হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। কিন্তু সেই কাঁটাতারের বেড়া কেটে করা হয়েছে ফাঁকফোকর। যা দিয়ে অবাধে ক্যাম্প ছাড়ছে অনেক রোহিঙ্গা, টাকা কামাইয়ের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে নানা পেশায়।
রোহিঙ্গারা বলছেন, কাঁটাতারের ফাঁকফোকর বা চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্প ছাড়ছেন তারা। লক্ষ্য, যে কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জন।
ক্যাম্প-৭ এর বাসিন্দা ইদ্রিস আলী বলেন, আমি কাজের সন্ধানে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে এসেছি।
এদিকে নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের অভিযোগ অনেক পুরানো। ভোটের মিছিল-মিটিং, প্রচার-প্রচারণা, পোস্টার লাগানোসহ নানা কাজে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হয়। তাই এবারও বেড়েছে সেই শঙ্কা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রার্থীদের দাবি, নির্বাচনে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল সহিংসতা ঘটাতে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে।
কুতুপালং ক্যাম্পসংলগ্ন রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, নির্বাচন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনেও রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। এই কাজে না জড়ানোর জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রচেষ্টা ও প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনের হস্তক্ষেপও জরুরি।
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা সংকট কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের জন্য সবচেয়ে বেশি বিপদসংকেত, ক্যাম্প থেকে এমনিতেই রোহিঙ্গা নানা কৌশলে বের হয়ে জেলা শহরের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়েছে, মিশে যাচ্ছে স্থানীয়দের সাথে যার ফলে প্রতিনিয়তই বাড়ছে চুরি ছিনতাই খুনসহ নানা অপরাধ। নিজেদের জনপ্রিয়তা দেখাতে বিভিন্ন প্রার্থী রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে সভা সমাবেশ নিয়ে আসতেছে বলে শুনা যাচ্ছে, যা ফলে নির্বাচনের নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঝুঁকি বাড়বে। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশি-বিদেশি নানা অস্ত্র উদ্ধার করতে দেখা গেছে। কোন ভাবে যদি জাতীয় নির্বাচনে কোন অশুভ শক্তি রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে তাহলে এর চরম মূল্য দিতে হবে স্থানীয়দের। মনে রাখতে হবে কক্সবাজার বাংলাদেশের অত্যন্ত সংবেদনশীল সার্বভৌম ভূখণ্ড। এই এলাকায় রোহিঙ্গাসহ অন্য সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে এবং স্থানীয় জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্তদের হাতে সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকার পরও । দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি এসব বিষয়ে আপস করেন, তাহলে মহাবিপদ হবে।
নির্বাচনকে ঘিরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরো নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি যাতে কোন ভাবেই রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাহিরে আসতে না পারে সেদিকে সকলের সুনজর রাখা দরকার।
কক্সবাজার-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. নুরুল বশর বলেন, মানবতার কারণে রোহিঙ্গাদেরকে উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৌশলে অনেক রোহিঙ্গাকে ব্যবহার করে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করবে স্বার্থান্বেষী মহল।
র্যাব ১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আমরা এ আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারি না। যে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল রোহিঙ্গাদেরকে নির্বাচনকেন্দ্রিক যেকোনো কাজে ব্যবহার করতে পারে। ফলে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর প্রবেশদ্বারে রয়েছে এপিবিএনের চেকপোস্ট। কিন্তু এসব চেকপোস্টেও দেখা যায় ঢিলেঢালা ভাব। তবে নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার না করতে সব প্রার্থীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। আর সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা রয়েছে। এই রোহিঙ্গারা যাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো প্রক্রিয়ায় জড়িত হতে না পারে এই জন্য কক্সবাজারের সব প্রার্থীর কাছে সহযোগিতা চাই।’
উখিয়া ৮ এপিবিএনের সহঅধিনায়ক (পুলিশ সুপার) খন্দকার ফজলে রাব্বী বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় এপিবিএনসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্ব পালন করছে। ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরের তল্লাশি চৌকি বাড়ানো হয়েছে। নির্বাচনের দিন কঠোর অবস্থানে থাকবে প্রশাসন। যেন আশ্রিত রোহিঙ্গারা ক্যাম্পেই অবস্থান করে। এপিবিএন সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, নির্বাচনের সময় রোহিঙ্গা যুবকেরা যেন ক্যাম্পের বাহিরে না যায়, সেজন্য ৩৩টি জমকালো ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হবে। নির্বাচনের দিন ভলিবল খেলার ব্যবস্থাও থাকবে। এক মাস আগে থেকেই নজরদারির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কোনোভাবেই যেন রোহিঙ্গাদের এই কাজে জড়ানো না হয় সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে।