সাইদুল ফরহাদ, সেন্টমার্টিন থেকে:
সেন্টমার্টিন দ্বীপের কোনারপাড়ার বাসিন্দা আদনান। বাপ-দাদার ভিটেমাটিতে জন্ম থেকে শুরু করে শৈশব-কৈশোরও কেটেছে এ দ্বীপে।
৩৫ বছর বয়সের জীবনে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র তান্ডবের মতো ভয়াবহতা আর কখনও দেখেননি। বাপ-দাদার কাছে শুনেছেন ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকারী ঘুর্ণিঝড়ের সময়ও সামান্যটুকু ক্ষতি হয়নি সেন্টমার্টিনের। তবে এবার কেন এতো ভয়াবহতা?
আদনান মনে করেন এবার মোখা’র আঘাত ভয়াবহ হওয়ার কারন দ্বীপের কেয়াবন নির্বিচারে ধ্বংস করার প্রবনতা। একসময় দ্বীপের চারপাশে কেয়াবনের যে ঝোপ ছিল তা এখন অবশিষ্ট নেই।
মঙ্গলবার (১৬মে) সকালে আদনান বলেন,ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে আমাদের দ্বীপে দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি, দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে ১ হাজার ২০০টির বেশি ঘর। এর মধ্যে মাঝেরপাড়া, কোনারপাড়া, গলাচিপা, দক্ষিণপাড়া, পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়ার অধিকাংশ কাঁচা ঘরবাড়ি মিশে গেছে মাটির সঙ্গে।
আদনান আরো বলেন, আমাদের দ্বীপকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে প্রবাল ও কেয়াবন। আমাদের দ্বীপে কেয়াবন ও প্রবালকে বলা হয় দ্বীপের ‘রক্ষাদেয়াল’। যতবড় দুর্যোগ আসুক না কেন কেয়াবন ও প্রবাল আমাদের রক্ষাদেয়াল হিসেবে কাজ করে এসব দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু দ্বীপের সারিবদ্ধ কেয়াবন উজাড় এবং প্রবাল ধ্বংস করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাঁচ বছর আগেও দ্বীপের চারপাশে কেয়াবন ছিল প্রায় ২০ কিলোমিটার। উজাড় হতে হতে সেই বন এখন ঠেকেছে ৮ কিলোমিটারে। প্রায় ১২ কিলোমিটার কেয়াবন নেই।
কেন এই কেয়াবন ও প্রবাল ধ্বংস করা হচ্ছে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, দ্বীপের কেয়াবন উজাড়ের একমাত্র কারণ হোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ। এসব স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে কেয়াবন আগুনে পুড়িয়ে ও কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। এর ফলে সৈকতের বালিয়াড়ি বিলীন হচ্ছে। এর প্রভাবও ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। দুই বছর ধরে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হচ্ছে দ্বীপের শত শত নারকেলগাছ ও বসতবাড়ি, যা আগে কখনো হয়নি বলে জানান স্থানীয় এই বাসিন্দা।
শুধু আদনের একজনের অভিযোগ নয় একই অভিযোগ দ্বীপের অন্য বাসিন্দাদেরও।
জামাল হোসন নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, এই ছোট্ট দ্বীপে ৪শত থেকে সাড়ে ৪শত হোটেল রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। এসব হোটেলে মালিক এর সন্ধান করলে দেখবেন স্থানীয় নয় সব বহিরাগতদের । স্থানীয়রা একটি বালির বস্তা নিলেও তাদের আইনের আওতায় আনা হয়। আর বড় বড় হোটেল রিসোর্টের মালিকরা সাগর থেকে প্রবাল ও কেয়াবন উজাড় ও ধ্বংস করলেও প্রশাসন অদৃশ্য ভাবে নিরবতা পালন করেন। এদের কানের এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঘূর্ণিঝড় মোখা) আঘাত এনেছে।
দ্বীপের স্থানীয় এই দুই বাসিন্দার কথামত আমরা কেয়াবন ও প্রবাল ধ্বংসের চিত্র দেখতে যাই দ্বীপের কোনারপাড়া সৈকতে নামতে কয়েকটি হোটেলের পাশে। কেয়াবন ও প্রবাল ধ্বংসের এই চিত্র ধরা পরে আমাদের হাতে।
যেখানে দেখা যায়, কেয়াবন কেটে আগুন ধরিয়ে দিয়ে উজাড় করা হয়েছে। আর সাগর থেকে প্রবাল তুলে হোটেল রিসোর্টের সীমানা রক্ষা করা হচ্ছে। দ্বীপের বাসিন্দারা বলছেন অবশিষ্টটুকুও কত দিন টিকে থাকবে, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন তাঁরা। হয়তোবা একদিন এই দ্বীপ পানির সাথে তলিয়ে যাবে।
সেন্টমার্টিনের আরেক বাসিন্দা জসিম উদ্দিন শুভ বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের দিন (১৪মে) সবাই আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে সবাই ঘরে চলে যায়। বয়স্ক লোকরা বলাবলি করছিল এখানে কিসের ঘূর্ণিঝড়। কিছু হবে না। তারপরও আমরা বিজিবি, কোস্ট গার্ডদের সহায়তায় আশ্রয় কেন্দ্রে ফেরানোর চেষ্টা করি। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। মোখা তান্ডব শুরু করে। শুরু মূহুর্তের বাতাসের গতির সাথে বৃষ্টি শুরু হয়। মনে হচ্ছিল বাতাসের সাথে সাগরের পানি কূলের দিকে চলে আসছে। ঘরবাড়ি, গাছপালা সবকিছু উড়িয়ে যাচ্ছে। যারা আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়েছে তারা অনেকেই গাছ চাপা পড়ে আহত হয়েছেন। আমার শৈশব থেকেই এই পর্যন্ত আমি এইরকম ঘূর্ণিঝড় দেখেনি। চিন্তা করছি দ্বীপ ছেড়ে চলে যাবো। যেকোনো সময় পানির সাথে তলিয়ে যেতে পারে এই দ্বীপ। দ্বীপ দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। দ্বীপ ছোট হাওয়ার কারন আগে দ্বীপের চারপাশে কেয়াবন ও জেগে উঠা ছোট ছোট বেড়িবাঁধ ছিল। কিছু অসাধু লোক এগুলো ধ্বংস করে ফেলে। তাই দিনদিন দ্বীপে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে ।
তবে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের সময়ের অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো ভুলতে পারছি না। মনে হচ্ছিল এই জনমে মনে হয় এখানে শেষ।
এভাবে কেয়াবন ধ্বংসের পেছনে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের গাফিলতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা। আর স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ রক্ষাকারী কেয়াবন উজাড়ের প্রতিবাদ করলেও সুফল পাচ্ছেন না। কেননা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রভাবশালীরা ঠিকই পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে অবকাঠামো নির্মাণ অব্যাহত রেখেছেন।
পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন,
সেন্টমার্টিন দ্বীপের ‘রক্ষাদেয়াল’ কেয়াবন উজাড় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেন্টমার্টিনে কেয়াবন ধ্বংসের পেছনে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের গাফিলতি দায়ী। কেয়াবনের কারণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বালু স্থির থাকে, সরে যায় না। এই বন ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় সেন্টমার্টিনের পরিবেশের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে। ২০ কিলোমিটারের বন ঠেকেছে ৮ কিলোমিটারে। নানা স্থাপনা নির্মাণ করে ধ্বংস করা হচ্ছে এসব কেয়াবন। এভাবে দ্বীপের ‘রক্ষাদেয়াল’ কেয়াবন উজাড় হলে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবেনা,সামান্য বৃষ্টি কিংবা বড় কোন জোয়ার আসলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে।এখনি যদি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে এসব পরিবেশ প্রতিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে না পারে তাহলে দ্বিপটি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট সামুদ্রিক বিজ্ঞানী, কক্সবাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনষ্টিটিউট-বুরি এর মহাপরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেছেন, ‘গত একশ বছরেও সেন্টমার্টিন দ্বীপে কোনো প্রলয়ংকরি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানেনি। দ্বীপটিতে আঘাত হানেনি একদম লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া অনেক মানুষের প্রাণহানি হবার মতও কোনো দুর্যোগ। তবে এখন থেকে আরো বেশি হবে। কেয়াবন রক্ষাদেয়াল হিসাবে কাজ করে। বালির বন্ধন তৈরি, মাটির ক্ষয়রোধ ও সামুদ্রিক বাতাসের তীব্র প্রবাহ ঠেকাতে ভূমিকার কারণে উপকূলীয় অঞ্চল সুরক্ষায় কেয়াগাছের গুরুত্ব বাস্তুশাস্ত্র বা পরিবেশ বিজ্ঞানে অপরিসীম। এই কেয়াগাছের বনই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির জনবসতি রক্ষা করে। কেয়াবন উজাড় করলে দ্বীপকে রক্ষা করা সম্ভব না। যদি এভাবেই ধ্বংস করা হয় একদিন তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে সেন্টামার্টিনেই ক্ষতি হয়েছে ১২০০ ঘরবাড়ি। এ ছাড়া অসংখ্য গাছপালা উপড়ে গেছে। প্রচণ্ড গতির বাতাস নিয়ে রবিবার (১৪ মে) বিকাল ৩টার দিকে কক্সবাজার ও মিয়ানমার উপকূল আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় মোখা।
সেন্টমার্টিনে ঘূর্নিঝড় মোখায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের মাঝে ত্রান তৎপরতা শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। এবং সেন্টমার্টিনের ক্ষতিগ্রস্থ ১২শ ঘর ঘরবাড়ির মেরামতে টেউটিন ও অর্থ সহায়তা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, আমরা সেন্টমার্টিন ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছি। দ্বীপ রক্ষায় দ্বীপে নতুন করে গাছ লাগানো হবে। এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।