শনিবার, জানুয়ারি ১৮, ২০২৫

বৈদেশিক আয়ের নতুন সম্ভাবনা ‘রাজ কাঁকড়া’

মিশু গুপ্ত:

সাগরজলের রহস্যময় প্রাণী ‘হর্সসু ক্র্যাব’ বা ‘রাজ কাঁকড়া’র নীল রক্তের বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য রয়েছে সারা বিশ্বে।রাজ কাঁকড়া হচ্ছে ঘোড়ার ক্ষুরের মতো দেখতে উপবৃত্তাকার একটি কাঁকড়া। লিমুলাস গণের অন্তর্ভুক্ত এর বৈজ্ঞানিক নাম লিমুলাস পলিফিমাস। একে কাঁকড়া বলা হলেও প্রজাতিগত দিক থেকে মাকড়সার সঙ্গে বেশি মিল রয়েছে। এরা প্রধানত অগভীর, নরম বালি বা কাদাসমৃদ্ধ সমুদ্রতলে বাস করে।

সাধারণত রাজ কাঁকড়ার জীবনচক্র ডিম, লার্ভা, জুভেনাইল এবং পূর্ণাঙ্গ দশা নিয়ে গঠিত। এরা ৯ থেকে ১২ বছর বয়সে প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং ১২ থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। পূর্ণ জোয়ারের সময় এরা প্রজনন করে এবং তখন কক্সবাজার, সোনাদিয়া, মহেশখালী এবং সেন্টমার্টিনস দ্বীপের নিকটে জলাভূমির বালুময় সৈকতে ফিরে আসে। এরা মূলত জৈব আর্বজনা ভুক প্রাণী। এদের অধিকাংশই সমুদ্রের তলদেশের ছোট প্রাণী, পোকা-মাকড় এবং ছোট মাছ শিকার করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এরা প্রধানত নিশাচর।

ডাইনোসরের চেয়েও প্রায় ২০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিল এই রাজ কাঁকড়া। আজ থেকে ৪৫ কোটি বছর আগে বিবর্তিত হয়ে এত দিন প্রায় অবিকৃত চেহারায় থেকে যাওয়ার জন্য এদের জীবন্ত জীবাশ্ম হিসেবে গণ্য করা হয়। কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই প্রাণীটি দিয় কিঁয়ারা বা দৈত্য কাঁকড়া নামে বেশি পরিচিত।

রাজ কাঁকড়া নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত সমুদ্র বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, প্রকৃতিতে অবিকৃত অবস্থায় প্রায় ৪৪ কোটি ৫০ লাখ বছর ধরে টিকে থাকা ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ রাজ কাঁকড়ার নীল রক্তের রয়েছে অসাধারণ ক্ষমতা। এদের রক্তে রয়েছে হিমোসায়ানিন। এতে কপার ও তামার উপস্থিতি থাকায় বাতাসের সংস্পর্শে এলে নীল বর্ণ ধারণ করে। এরা যে কোনও ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং বিষাক্ত পদার্থ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে।

মানবদেহে প্রয়োগের আগে, এ কাঁকড়ার রক্ত দিয়ে পরীক্ষা করে নেয়া যায়, টিকা বা ভ্যাক্সিন, জীবাণু মুক্ত কিনা। আজ পর্যন্ত ভ্যাক্সিন নিয়ে যত ধরনের গবেষণা হয়েছে এবং যত ধরনের ভ্যাক্সিন উৎপাদিত হয়েছে প্রত্যেকটির জন্যই প্রয়োজন হয়েছে এদের রক্ত। করোনা মহামারীকে নিয়ন্ত্রন করতে যেসব ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করা হয়েছে সেখানেও ব্যাবহার করা হয়েছে রাজ কাঁকড়ার মূল্যবান রক্ত।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধাংশে আমেরিকায় রাজ কাঁকড়া সার এবং পশু খাদ্য তৈরিতে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হতো। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ যেমন—থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং চীনে রাজ কাঁকড়ার ডিম সুস্বাদু খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর রক্তের রং নীল। মানুষের শরীরের দ্রুত রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে এবং মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করতে এই কাঁকড়ার নীল রক্ত অতুলনীয়। এ ছাড়া এর শরীরের পেছনে থাকা ছোট্ট লেজটি দিয়ে তৈরি করা হয় ক্যান্সারের ওষুধ। তাই চিকিৎসাশাস্ত্রে এই প্রাণীটির কদর দিন দিন বাড়ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যাপক ব্যবহারের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এই প্রাণীটির এক গ্যালন রক্ত বিক্রি হয় অন্তত ৬০ হাজার মার্কিন ডলারে।

২০১.৩ মিলিয়ন থেকে ১৪৫ মিলিয়ন বছর আগের জুরাসিক পিরিয়ডের পূর্ববর্তী যুগের প্রাণীটি প্রকৃতির চরমতম প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকলেও বর্তমানে চরম বিপন্ন অবস্থার মধ্যে রয়েছে এই প্রাণীটি। বিশেষ করে ওষুধি গুণের কথা প্রচার হওয়ার পর প্রাণীটি পড়েছে চরম ঝুঁকির মুখে।

আরও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ খবর

error: Content is protected !!