সিসিএন অনলাইন ডেস্ক:
আগামী ৭ জানুয়ারি রোববার ভোটগ্রহণের দিন রেখে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, এ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত, তা বাছাই হবে ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। তার তিন সপ্তাহ পর হবে ভোটগ্রহণ।
প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ হবে। সেক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমার জন্য ১৪ দিন সময় দেওয়া হয়েছে এবং প্রচারের জন্য ১৯ দিন সময় রয়েছে। ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রচার শেষ করতে হয়। অর্থাৎ, ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ভোটের প্রচার চালানোর সুযোগ থাকবে। এবার ৩০০ আসনেই ভোট হবে ব্যালট পেপারে।
নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক শিবিরে মতানৈক্যের মধ্যেই বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তফসিল ঘোষণা করেন সিইসি।
তফসিল ঘোষণার ভাষণে সিইসি বলেন, “রাজনৈতিক মতানৈক্যের সমাধান প্রয়োজন। আমি সকল রাজনৈতিক দলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব, সংঘাত পরিহার করে সমাধান অন্বেষণ করুন। সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়।”
একাদশ সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি, সেই সংসদের মেয়াদ আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে।
২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুসারেই তফসিল ঘোষণা করছে নির্বাচন পরিচালনাকারী সাংবিধানিক সংস্থাটি।
এমন এক সময় সিইসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেন, যখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন দুই শিবিরে বিভক্ত। সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সারা দেশে অবরোধের কর্মসূচি পালন করছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অবস্থানে অনড়।
সামনে কি হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। দশ বছর আগের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছে।
২০১৪ সালে সেই নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে নির্বাচনে জিতে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ভোটের ফলে তাদের ভরাডুবি হয়। সে সময় ‘আগের রাতে’ ভোট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যান করে দলটি। সংসদের মেয়াদের শেষ দিকে এসে তাদের নির্বাচিত এমপিরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এবার ২০১৪ সালের মত একই দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি। বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে রাজনীতিতে ফিরে এসেছে সহিংসতা। তাতে ডজনখানেক মানুষের প্রাণ গেছে। যানবাহনে অগ্নিংযোগ আর নাশকতার ঘটনায় জনমনে বাড়ছে শঙ্কা।
যুক্তরাষ্ট্র দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে নিঃশর্ত সংলাপের আহ্বান জানালেও বিবাদমান পক্ষগুলো তাতে সাড়া দেয়নি। বিএনপি এই সংলাপে কোনো ফায়দা দেখছে না। আর আওয়ামী লীগ বলেছে, এখন আর সংলাপের ‘সময় নেই’।
দেশের এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বিরোধের মীমাংসা না করে তফসিল ঘোষণা না করার আহ্বান জানিয়েছিল কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তবে নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট করে বলেছে, নির্বাচনের না আসার এখতিয়ার রাজনৈতিক দলের থাকলেও ইসির সামনে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের বিকল্প নেই।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পথে
- ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সে হিসাবে আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
- দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন ভোটার। তাদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন এবং নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। আর হিজড়া ভোটার রয়েছেন ৮৫২ জন।
- ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ভোটার ছিল ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন। সে হিসেবে পাঁচ বছরে দেশে ভোটার বেড়েছে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৫২ হাজার ৯৫৬ জন।
- বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল আছে ৪৪টি। এসব নিবন্ধিত দল ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।
- এবারের নির্বাচনে সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজার ১০৩টি এবং ভোটকক্ষ ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১২।
- ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। চার নির্বাচন কমিশনার হলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান। তাদের মেয়াদে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই হবে সবচেয়ে বড় কর্মযজ্ঞ।
- রোডম্যাপ ধরে তফসিল আগে-পরের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ থেকে ভোটের দিন ও ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশ পর্যন্ত কাজের ফর্দ নিয়ে নামবে ইসি।
এক নজরে তফসিলগুলো
সংসদ নির্বাচন | তফসিল ঘোষণার তারিখ | ভোটের তারিখ | তফসিল ঘোষণা থেকে ভোট পর্যন্ত সময় | ভোটের দিন |
প্রথম | ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি | ৭ মার্চ | ৬০ দিন | বুধবার |
দ্বিতীয় | ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর | ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি (পুনঃতফসিল) | ৫৪ দিন | রোববার |
তৃতীয় | ১৯৮৬ সালের ২ মার্চ | ৭ মে | ৪৭ দিন | বুধবার |
চতুর্থ | ১৯৮৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর | ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ | ৬৯ দিন | বৃহস্পতিবার |
পঞ্চম | ১৯৯০ সালের ১৫ ডিসেম্বর | ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি | ৭৮ দিন | বুধবার |
ষষ্ঠ | ১৯৯৫ সালের ৩ ডিসেম্বর | ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি (পুনঃতফসিল) | ৫৫ দিন | বৃহস্পতিবার |
সপ্তম | ১৯৯৬ সালের ২৭ এপ্রিল | ১২ জুন | ৪৭ দিন | বুধবার |
অষ্টম | ২০০১ সালের ১৯ অগাস্ট | ১ অক্টোবর | ৪২ দিন | সোমবার |
নবম | ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর | ২৯ ডিসেম্বর (পুনঃতফসিল) | ৪৭ দিন | সোমবার |
দশম | ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর | ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি | ৪২ দিন | রোববার |
একাদশ | ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর | ৩০ ডিসেম্বর (পুনঃতফসিল) | ৪৬ দিন | রোববার |
দ্বাদশ | ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর | ৭ জানুয়ারি | ৫৩ দিন | রোববার |
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ৫৩ দিন সময় দিয়ে তফসিল ঘোষণা করল নির্বাচন কমিশন। এবার ইসিতে নিবন্ধিত দল রয়েছে ৪৪টি, তারাই দলীয়ভাবে ভোট করার সুযোগ পাবে।
প্রথম সংসদ নির্বাচনে ৬০ দিন সময় দিয়ে তফসিল হয়েছিল। তাতে ১৪টি দল অংশ নেয়।
৫৪ দিন সময় দিয়ে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট হয়। ২৯ দল তাতে অংশ নেয়।
তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪৭ দিন সময় দিয়ে তফসিল হয়। সেই নির্বাচনে অংশ নেয় ২৮টি দল।
চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে ৬৯ দিন সময় রেখে তফসিল হয়েছিল। মাত্র ৮টি দল সেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৭৮ দিন সময় দিয়ে তফসিল হয়েছিল। তাতে ৭৫টি দল অংশ নেয়।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে তফসিল দিয়ে তিনবার পরিবর্তন করতে হয়। অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে এতে অংশ নেয় ৪১টি দল।
সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ৪৭ দিন সময় দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ ৮১টি দল অংশ নেয় তাতে।
সবচেয়ে কম ৪২ দিন সময় দিয়ে অষ্টম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ৫৪টি দল তাতে অংশ নেয়।
নবম সংসদ নির্বাচনেও ৪৭ দিন সময় নিয়ে ভোটের তফসিল ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনে অংশ নিতে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করায় কেবল নিবন্ধিত ৩৮টি দল অংশ নেয়।
দশম সংসদ নির্বাচনে ৪২ দিন সময় দিলে তফসিল ঘোষণা করে, দল অংশ নেয় ১২টি। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো ভোট বর্জন করে এবং ১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড হয়।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪৬ দিন সময় দিয়ে তফসিল ঘোষণা করার পর এক সপ্তাহ পিছিয়ে নিয়ে পুনঃনির্ধারণ করা হয় ভোটের তারিখ। তাতে ৩৯টি দল ভোটে অংশ নেয়।
সূত্র: বিডিনিউজ২৪