সোমবার, অক্টোবর ২, ২০২৩

সিনহা হত্যার তিন বছর,ফাঁসি কার্যকর চান কক্সবাজারবাসী

সিসিএন প্রতিবেদক:

পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের তিন বছর আজ সোমবার (৩১ জুলাই)।

সেই হত্যার ৩ বছরে এসে মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার বিচারের রায় কার্যকর করার দাবিতে সোমবার (৩১ জুলাই) বিকেল ৩ টায় আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। নিহত মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান’র পরিবার ও কক্সবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্য পরিবারবর্গের উদ্যোগে কক্সবাজার শহরের শহিদ সুভাষ হল (পাবলিক লাইব্রেরি হল) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন
ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলী’র গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। পুলিশের গুলিতে মেজর (অব:) সিনহা হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে তখন ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

তখন নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ
খানের গাড়ি থেকে কিছু ইয়াবা, গাঁজা ও মদ উদ্ধারের বানোয়াট কথা বলে পুলিশ। পুলিশের পক্ষ হতে এসব বানোয়াট গল্প নিয়ে দায়ের করা হয় একাধিক মামলা। কিন্তু ঘটনার পরদিনই পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘রাওয়া’ এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সোচ্চার হয়।
গণমাধ্যমে বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় জনগণও প্রতিবাদী হয়ে উঠে। তাতে আলোচিত সিনহা হত্যা মামলা গুরুত্বের সঙ্গে দ্রুত তদন্ত ও অভিযোগপত্র দায়েরের মাধ্যমে তা বিচারিক পর্যায়ে চলে যায়।

হত্যাকাণ্ডের ৫ দিনের মাথায় ২০২০ সালের ৫
আগস্ট নিহত সিনহা’র বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার
ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার তৎকালীন
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), পরে বিচারিক আদেশে
মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়া প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে
আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নম্বর : এসটি-৪৯৩/২০২১ ইংরেজি। যার
জিআর মামলা নম্বর : ৭০৩/২০২০ ইংরেজি। যার
টেকনাফ মডেল থানা মামলা নম্বর : ৯/২০২০
ইংরেজি।

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কক্সবাজার জেলা পুলিশ
প্রশাসনের পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার,
সহকারী পুলিশ সুপার, এসআই, এএসআই,
কনস্টেবল সহ কক্সবাজার জেলা পুলিশের প্রায় ১৪
শত সদস্যকে কক্সবাজার থেকে একযোগে বদলি করা হয়। গঠিত হয় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয়
কমিশনার (যুগ্মসচিব) মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ৪
সদস্য বিশিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি। এই কমিটি তদন্ত শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ সহ তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে করা মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী-কে। ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর
আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি করা হয়
টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল
রক্ষিত’কে। আদালত থেকে র‍্যাব-১৫ কে মামলাটির
তদন্তভার দেওয়া হয়।

এরপর মামলার আসামি ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে
আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় ৩ জন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের
(এপিবিএন) এর ৩ সদস্য এবং প্রদীপের দেহরক্ষীসহ আরো মোট ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। ২০২১সালের ২৪ জুন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসে। আসামিদের মধ্যে ১২ জন নিজেদের দোষ স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতের কাছে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দেন। শুধু ওসি প্রদীপ, কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং সাগর দেব আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেননি।

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চার মাসের বেশি সময় ধরে
চলা তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জন সাক্ষী সহ আলোচিত মামলাটির চার্জশিট
(অভিযোগপত্র) দাখিল করেন র‍্যাব-১৫ এর তৎকালীন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে মেজর (অব:)সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

র‍্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) বিভিন্ন ধরনের
আলামত ও ডিজিটাল কন্টেন্ট আমলে এনে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের মামলায় চার্জশিট দেন।
চার্জশিট থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৭ জুলাই
সিনহা মো. রাশেদ খান, শিপ্রা দেবনাথ, সিফাত ও
রুফতি নীলিমা রিসোর্টে অবস্থান করেন। ইউটিউবে
একটি ভিডিও চ্যানেল নিয়ে কাজ করার সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা হয়। সাধারণ মানুষ পুলিশের মাধ্যমে তাদের জিম্মিদশা, অত্যাচারের ঘটনা মেজর সিনহা’কে জানায়। এসব জেনে সিনহা মানসিকভাবে খুবই পীড়িত হন।

আরো জানা গেছে, টেকনাফের ওসি প্রদীপের কথিত স্বর্গরাজ্য ছিল পুরো টেকনাফ। মূলত তার
স্বেচ্ছাচারিতা, আইন অমান্য করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি
প্রতিষ্ঠা এবং তার অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য
সিনহা ও তার সঙ্গীরা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ওসি প্রদীপ সরকারি অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করতেন এবং ইয়াবাকেন্দ্রিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

এসব বিষয়ে ওসি প্রদীপের কাছে জানতে ক্যামেরা ও ডিভাইসসহ সিনহা, শিপ্রা ও সিফাত থানায় যান।
র‍্যাবের অভিযোগপত্রে বলা হয়, থানায় তাদের
অনতিবিলম্বে টেকনাফ বা কক্সবাজার ছেড়ে যেতে
বলা হয়। ‘তা না হলে তোমাদের আমি ধ্বংস করে
দেব’ বলে হুমকি দেন প্রদীপ। ওসি প্রদীপের হুমকি
উপেক্ষা করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কারণেই ষড়যন্ত্র করে মেজর সিনহাকে হত্যা করা হয় বলে জানায় তদন্তকারী কর্মকর্তা।

কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে কিছুদিন আদালতের স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল তাঁর আদালতে মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু করেন।

কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি ৩০০ পৃষ্ঠার এ মামলার ঐতিহাসিক রায় দেন। মামলায় ২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ৬ আসামিকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করা হয়। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া আসামীরা হলো-বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

এছাড়া একই রায়ে ৬ আসামি যথাক্রমে কনস্টেবল
সাগর দেব, রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত,
পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন, আয়াজ উদ্দিনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। রায়ে সাজাপ্রাপ্ত ৮ জন আসামির প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়।

মামলার বাকী ৭ জন আসামিকে মামলার দায় থেকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়। তারা হলো কনস্টেবল সাফানুর করিম, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো.শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব, কামাল হোসেন আজাদ ও মো. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ।

এ রায়ের পর বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল তাঁর দৃঢ়চেতা ও সাহসী রায়ের জন্য প্রশংসায় ভাসতে থাকেন। বিচারকের আন্তরিকতা, দক্ষতা, নিয়মানুবর্তিতা ও অভিজ্ঞতার বিষয়টি বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সবার মুখে মুখে ইতিবাচক আলোচনা হতে থাকে। এতে সারাদেশে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়। বিচারপ্রার্থীদের মাঝে বিচারবিভাগের প্রতি আস্থা আরো বাড়তে থাকে। প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসে “বিচার বহির্ভূত
হত্যাকাণ্ড”। ফৌজদারি অপরাধ বিশেষজ্ঞরা এ
রায়কে একটি ঐতিহাসিক, যুগান্তকারী ও দৃষ্টান্তমূলক রায় বলে অভিহিত করতে থাকেন।

সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা পরে কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করে। হাইকোর্টে দায়েরকৃত আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট জানা গেছে।

রায় কার্যকর করার দাবিতে সভা :

মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা
মামলার বিচার কার্যকর করার দাবিতে সোমবার (৩১জুলাই) বিকেল ৩ টা আলোচনা সভা ও দোয়া
মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। নিহত মেজর
(অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান’র পরিবার ও
কক্সবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের উদ্যোগে
কক্সবাজার শহরের শহিদ হল (পাবলিক লাইব্রেরি হল)এ আয়োজিত হবে এই অনুষ্ঠান।

ক্ষতিগ্রস্ত ফরিদুল মোস্তাফা বলেন,ওসি প্রদীপের কারণে আজ নিঃস্ব । তার ফাঁসি কার্যকর হলে আমরা কক্সবাজারবাসী খুশি হবো। ফাঁসি কার্যকর করতে কাল আমরা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেছি। আমাদের আন্দোলন সফল হবে।

মামলার রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষের আইনজীবী কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, খালাসপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবিতে আমরা আমরা একটি রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করেছি। তবে উচ্চ আদালতের কাছে আবেদন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের আপিল শুনানি দ্রুত করে এর বিচার নিশ্চিত করা হোক।

আরও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ খবর